ডেঙ্গু আসলে ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে আক্রান্ত মানুষ থেকে অন্য মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরে প্রবেশ করার ৪ থেকে ১০ দিন পর রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। এ কারণে জটিলতাও বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত রোগী অনেকেরই যকৃৎ আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। কিডনির কার্যকারিতায়ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। পানি আসছে বুক ও পেটে এবং মাঝেমধ্যে নিউমোনিয়া দেখা যাচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘাম, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, রক্তচাপ কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
ডেঙ্গু জ্বর আসলে কী
ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়ে থাকে। তাই ডেঙ্গু জ্বরও চারবার হতে পারে। যাঁরা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু হলে তা ভয়াবহ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। গতবারের মতো এবারও ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের দেশে টাইপ-৩ দিয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের সংক্রমণ ঘটেছে। ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রদাহের সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে রক্তনালি, লিভার এবং শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর। রক্তনালি থেকে প্রচুর জলীয় অংশ বা প্লাজমা রক্তনালির বাইরে চলে আসে। ফলে রক্তের জলীয় অংশের পরিমাণ ও রক্তচাপ কমে যায়। রক্তনালির ভেতরে বা বাইরে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে ব্রেইন, কিডনি, লিভার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। লিভার ইনফেকশনের কারণে প্রোটিন প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি হতে পারে না। রক্ত জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় উপাদান প্লাটিলেটের ঘাটতি দেখা যায়। তখন শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এ সবকিছুর সামগ্রিক প্রভাবে শিশু আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
রক্তনালি থেকে বের হয়ে আসা প্লাজমা বা পানি ফুসফুস, পেট, হার্টসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে জমে যায়। রক্তচাপ কমে গিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। এভাবেই দেহের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের কার্যক্ষমতা লোপ পায়।
ডেঙ্গু রোগের প্যাথলজি এবং এর উপসর্গ অনেকটা প্রাপ্তবয়স্কদের মতো হলেও শিশুরা অল্প সময়ের মধ্যেই রোগের জটিলতা এবং ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এটা তাদের নাজুক শারীরিক গঠন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার কম ক্ষমতা বা জটিলতায় ঝুঁকি সামলানোর অপরিপকস্ফতার জন্যই হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ
– সাধারণভাবে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত শিশুদের লক্ষণ বড়দের মতোই হয়ে থাকে।
– শিশুর শরীরে মাঝারি বা তীব্র মাত্রার জ্বর এক থেকে পাঁচ দিন থাকে। জ্বরের সঙ্গে দেখা দেয় ক্ষুধামান্দ্য ও বমি বমি ভাব। অনেক সময় শরীরে র্যাশ দেখা দিয়ে থাকে। মাথা বা শরীরের ব্যথায় শিশু অযথা কান্নাকাটি বা বিরক্ত করতে থাকে। কখনও কখনও বমি, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা এমনকি খিঁচুনি হতে পারে।
-অনেক সময় হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন- মাড়ি, নাক, চোখের কনজাংকটিভায় রক্তক্ষরণের চিহ্ন দেখা যায়।
-পানি আসার কারণে অনেক সময় পেট ফুলে যেতে পারে। ফুসফুসে পানি জমে শিশুর কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
-কিশোরী মেয়েদের মাসিকের সময় বেশি রক্তপাত হতে পারে।
-দু-তিন দিন পর জ্বর কমে গেলে রোগটি প্রশমিত না হয়ে উল্টো শরীরে শক বা চেতনাহীন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। শুরুতে শিশুর নাড়ির স্পন্দন দ্রুত বাড়তে থাকে। এক সময় রক্তচাপ কমে যায়, নাড়ির স্পন্দন তখন অনুভূত হয় না। শিশু শকে চলে যায়। এই শক প্রতিহত করতে না পারলে তা থেকে প্রাণহানির কারণ হতে পারে। এ জন্য শিশু বা বড় যে কোনো রোগীর জ্বর কমে গেলেও নাড়ির স্পন্দন এবং রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে।
মা-বাবা বা অভিভাবকের করণীয়
-ডেঙ্গু রোগাক্রান্ত শিশুদের শরীরে তীব্র জ্বর দেখা দেয়। এ জন্য নির্দিষ্ট মাত্রায় প্যারাসিটামল সেবন, স্পঞ্জিং বা হালকা গরম পানিতে শরীর মুছে দেওয়া এবং বেশি বেশি তরল খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।
-তরল খাবার, খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, শরবত, স্যুপ, ডালের পানি ইত্যাদি বেশি বেশি পান করাতে হবে।
– প্রস্রাব যথেষ্ট ও ঠিকমতো করছে কিনা, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ছয় ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না হলে শিশুকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা উচিত।
-নিয়মিত নাড়ির স্পন্দন, রক্তচাপ মাপা জরুরি। শিশুর রক্তচাপ মাপার জন্য নির্দিষ্ট মাপের ব্লাড প্রেশার কাফ ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য নিকটস্থ চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিন।
– শিশুর জ্বরের সঙ্গে রোগসংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেওয়ার আগেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং তাঁর নির্দেশে রক্তের কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাবেন। কোনো শিশুর জ্বর ৫-৬ দিন পার হয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গুর উপস্থিতি নির্ণয়ে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাবেন। ডেঙ্গুর অ্যান্টিবডি ৫-৬ দিন আগে ধরা পড়ে না। এ জন্য আগেভাগে অ্যান্টিবডি টেস্ট করার দরকার নেই। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করাতে হবে।
জ্বর কমে গেলেও অর্থাৎ ষষ্ঠ দিন থেকে নিশ্চিত না হয়ে নিবিড়ভাবে রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
ডেঙ্গু যখন চিন্তার কারণ
ষশরীরের যে কোনো অংশ থেকে রক্তপাত হলে, যেমন- চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা, দাঁতের মাড়ি ও নাক থেকে বা বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া ইত্যাদি। পায়খানার সময় প্রতিবারই খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, কালচে পায়খানা রক্তক্ষরণের একটা লক্ষণ।
ষহঠাৎ শিশুর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলে।
-প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে।
-শ্বাসকষ্ট হলে বা পেটে পানি জমলে।
-প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলে।
-জন্ডিস দেখা দিলে।
-অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা দেখা দিলে।
-পেটে প্রচণ্ড ব্যথা বা বমি হলে।
-শিশু অচেতন হয়ে পড়লে।
-শরীরে খিঁচুনি দেখা দিলে।
-এ সময় শিশুদের মশার কামড় থেকে দূরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন। ফুলহাতা জামা-প্যান্ট ও মোজা পরান। দিনের বেলায়ও বিশ্রাম নেওয়ার সময় মশারি ব্যবহারে শিশুকে অভ্যস্ত করুন। বাড়ি মশামুক্ত রাখুন। পর্দার পেছনে, বাথরুমে অ্যারোসল বা মশার ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করুন। ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় শিশুর ত্বকে ডিডিইটিযুক্ত মশা প্রতিরোধক ক্রিম বা স্প্রে লাগান। বাড়িতে কারও ডেঙ্গু হলে তাঁকে সার্বক্ষণিক মশারির ভেতর রেখে যত্ন নিন, যাতে রোগ ছড়াতে না পারে। ডেঙ্গুর সঙ্গে শিশুর করোনা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিশুকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতাল বা বাসায় আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে। া
ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার
[অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, শিশু বিভাগ,
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল]
পাঠকের মতামত